
স্যার
“স্যার ভালো আছেন?” সাত সকালে মাছের বাজারে এই ডাক শোনা আর পায়ে পাওয়া প্রণামের স্পর্শ দুটোই অপ্রত্যাশিত ছিলো অমিয়বাবুর কাছে। পাশ ফিরতেই দেখলেন, তাঁর স্কুলের পুরোনো ছাত্র সুজয় মাথা তুলে দাঁড়ালো প্রণাম সেরে। “আরেহ! কাকে দেখছি?” সুজয়ের পিঠে বেশ সজোরে একটা স্নেহের চাপড় মেরে উৎফুল্ল গলায় বললেন অমিয়বাবু, “বল! কেমন আছিস?”
-“চলছে স্যার!”
-“চললে হবে না, দৌড়তে হবে।”
হুট করে কথাটা শুনে হেসে ফেললো সুজয়। স্বাভাবিক ভাবেই অনেক পুরোনো স্মৃতি ইতিমধ্যেই ওর মাথায় ভিড় জমিয়েছে।
মানুষ ও শিক্ষক হিসাবে বরাবরই সোজাসাপ্টা হিসাবে পরিচিত অমিয় মজুমদার বিখ্যাত (কিছুটা কুখ্যাতও) ছিলেন সবকিছু “অতিরিক্ত” করার জন্য। স্নেহ, শাসন, প্রত্যাশা, তিরস্কার, ভালোবাসা সবটাই তাঁর থাকতো চরমে। তবে তাঁকে ঘিরে যে জনপ্রিয়তা ছিলো তাকে “অতিরিক্ত” তকমা দেয়নি কেউ। তাই অবসরের অর্ধদশক পরও এরকম হুটহাট ডাক পাওয়াটা অমিয়বাবুর কাছে অপ্রত্যাশিত হলেও অপরিচিত নয় তেমন।
-“তাহলে তুই এখন বাইরে থাকিস তো?”
-“হ্যাঁ স্যার, মেসেই ছিলাম। ছুটির পর লকডাউন হয়ে গেলো, থেকে গেলাম ওই জন্যই।”
-“ভালো করেছিস। তা বল, কী করছিস এখন?”
প্রশ্নটা শুনতেই একটু যেন থমকে গেলো সুজয়। ব্যাপারটা চোখ এড়ালোনা অমিয়বাবুরও, দুর্ভাগ্যবশত সুজয় ওনার প্রথম ছাত্র নয় যার কাছ থেকে “কী করছিস এখন?” প্রশ্নের এরকম প্রতিক্রিয়া পেলেন।
-“এইতো স্যার, মাস্টার্স কমপ্লিট করে কোচিং নিচ্ছি, দেখা যাক কী হয় এখন।”
-“হবে, হবে! সব হবে! চাপ নেই, ঠিক বেরিয়ে যাবি!”
……………………
এভাবে সকাল সকাল মন ভালো হয়ে যাবে, তা বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় আন্দাজ করতে পারেনি সুজয়।
“হবে, হবে! সব হবে!” অমিয়বাবুর কথাটায় শুধু উৎসাহই ছিলো না, মিশে ছিলো ফেলে আসা শৈশবের সেই নির্ভেজাল সম্বোধন। সুজয়ের মতো কারোর খুব দরকার পড়ে মাঝেমধ্যে এরকম একটা স্নেহসুলভ শাসনের।
হঠাৎ একটা চেনা জোরালো আওয়াজ কানে আসে ওর, সুজয় দেখে ওর ফোন বাজছে। ফোন রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে ভেসে আসে সুজয়ের টিউশনের ছাত্র সিঞ্চনের গলার স্বর, “স্যার!”
-”কী রে, কী বলছিস? আজ পরীক্ষা না তোর?”
-”হ্যাঁ স্যার! ভয় লাগছে, কী হবে?”
কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেল সুজয়, একমুহুর্ত ভেবে নিয়ে বলে উঠলো…
“হবে, হবে! সব হবে! চাপ নেই, ঠিক বেরিয়ে যাবি!”
এই লেখা উৎসর্গকৃত সেই সকল পথপ্রদর্শককে যাঁরা আমার কাছে “শিক্ষক” নামের সংজ্ঞা এবং উদাহরণ।