
ঘাটে ঘ
নিশাকর নাথের জীবন ঠিক বর্ণময় না হলেও চলছিলো ধীরে সুস্থে, মানে ঐ আর পাঁচটা সাধারণ জীবন যেমন চলে আর কি! এলাকার একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ এবং অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসাবে তার ভালোই সুনাম আছে। আয়ও খারাপ না, খাওয়া পরার বন্দোবস্ত হয়ে যায়। মোটের ওপর ঐ, চলে যায়, থেমে থাকে না। কিন্তু নিশাকরের জীবনে শান্তি নেই, একটা অজানা শূন্যতা রোজ তাকে শুতে যাওয়ার আগে আর ঘুম থেকে ওঠার পর একবার করে গ্রাস করে। দমবন্ধ হয়ে আসে নিশাকরের, তার মনে হয় যেন সমাজ নামক এই প্রতিষ্ঠানকে সে বঞ্চিত করছে তার এই দৈনন্দিন জীবনের খাঁচায় আটকে থেকে। কিন্তু মুক্তি কোথায়? এ খাঁচা যে রুদ্ধদ্বার নয়, অনন্ত!
নিজের জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট না হলেও নিশাকরের শিক্ষানবিশদের মধ্যে কোনোরকম অসন্তুষ্টি ছিল না তাকে নিয়ে। বরং তারা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উৎসাহী থাকতো “স্যারের পড়ানো” নিয়ে। নিশাকরও যেন প্রাণবায়ু পেত ওদের মাঝে, কেউ যাতে ওর মতো ভুলের খাঁচায় আটকে না পড়ে তার জন্য পরামর্শ দিত নানারকম। চুপ করে শুনত সবাই। কেউ সবটা বুঝত, কেউ আর্ধেকটা, কিন্তু মুগ্ধ হতো প্রত্যেকে। একদিন তো এক মুগ্ধ জ্ঞানার্থী বলেই বসলো, “স্যার! আপনার কথাগুলো যে কী পরিমাণে উৎসাহিত করে বলে বোঝাতে পারব না! শুধু পড়াশুনো নিয়ে না, জীবন নিয়েও পসিটিভিটি পাই একটা……” তাল মিলিয়ে আরেক মুগ্ধ জ্ঞানার্থী বলে উঠলো, “হ্যাঁ স্যার! আপনার কথা পুরো বুস্টারের কাজ করে! আমরা সত্যিই খুব লাকি আপনার কাছে পড়তে পেরে!” ভালো লাগে নিশাকরের, বাচ্চাগুলোর জীবন অবধি প্রভাবিত করতে পেরে, সন্তুষ্টি না এলেও একটা অদ্ভুত তৃপ্তি পায় নিজেকে নিয়ে।
জীবন চলতে থাকে এভাবেই, থেমে থাকে না, অনেকটা যেন নিশাকরের বাড়ি থেকে চারশো কুড়ি মিটার দূরে থাকা নদীটার মত। তবে নদীতে তো জোয়ারও আসে, ভাটাতেই তো আটকে থাকে না? তাহলে জীবনটা এরকম কেন? ঘাটে বসে গভীর চিন্তায় মগ্ন নিশাকরের সম্বিত ফিরল ওপাড় থেকে ভেসে আসা মরাকান্নায়। চিতার আগুন সবে স্বরূপ ধারণ করছে আর কালো ধোঁয়া উড়ে চলেছে নদীর হাওয়ার সমান্তরালে। এমন সময় একটা ঠাণ্ডা হাওয়া যেন দোলা দিয়ে গেল নিশাকরের চেতনায়। জোয়ার ততক্ষণে দৃষ্টিগোচর জায়গায় চলে এসছে। প্রকৃতির সাথে আগে কখনও এতটা একাত্মবোধ করেনি নিশাকর, যেন এই জোয়ার; এই হাওয়া তার টানেই এসছে! সেদিন রাতে আর শূন্যতা গ্রাস করেনি, উল্টে দোলা লাগা চেতনা রাত একটা নয়ের আগে ঘুমোতে দেয়নি নিশাকরকে! এমনকি পরের দিন সকালেও আর শূন্যতা গ্রাস করেনি!
সেদিনের পর থেকে সবকিছু যেন নতুন রঙে সেজে উঠেছে, নতুন আনন্দ! নতুন চেতনা! তাহলে এবার কী? ব্যাপারটা তো কাজেও লাগাতে হবে! তাই দিন দুয়েক বেপাত্তা হয়ে বেরিয়ে পড়লো নিশাকর, নতুন কর্মের সন্ধানে। দেখতে দেখতে দুদিন কেটে গেল, ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে এল নতুন জীবনের নতুন উদ্দেশ্য নিয়ে। তারপর শুরু হল আসল কাজ, কাজ করা। রাতারাতি নিজের আগের জীবনের ভুলগুলো শুধরাতে লাগল নিশাকর। সকাল শুরু করতে লাগল যোগ ব্যায়াম ও ধ্যান দিয়ে। দেখতে পেত চোখ বুজলেই, যেন ভরা জোয়ারের জলে নিজের সত্য সত্ত্বার প্রতিফলন দেখতে পাচ্ছে। বেশ কয়েকদিন এভাবেই চলল, গতে বাঁধা জীবনের ভুলের খাঁচা থেকে মুক্তির পথ পেতে লাগল আত্মমগ্ন নিশাকর।
এরপর? ঠিক কী করা উচিৎ এরপর? প্রশ্নটা সহজ হলেও উত্তরটাও যে খুব কঠিন তাও কি? এতদিনের মিথ্যা দিয়ে সাজানো স্বাছন্দ্যের জীবনে থেকে সমাজ কে কতই না বঞ্চনা করেছে নিশাকর, ভাবতেও কষ্ট হয়! এখন চোখ খুলেছে, চেতনা জেগেছে! এই তো সময় প্রাণ উজাড় করে কাজ করার! বিধাতাও যেন সহজ করে দিলেন নিশাকরের পরের ধাপের কাজটা! একদিন ফোন এল, আর ফোনের ওপারে সেই সেইদিনের মুগ্ধ জ্ঞানার্থী, “স্যার! প্রণাম নেবেন! আপনার গাইডেন্সে আমি ভালো ভাবে পাস করে গেছি! হায়ার স্টাডিস করতে চাই স্যার! আর আপনাকে ছাড়ছি না, আমি কিন্তু আপনার কাছেই পড়ব! আপনার মত উচ্চশিক্ষিত হতে চাই!” ঠিক যে মুহুর্তে প্রাক্তন শিক্ষানবিশের উৎসাহী গলার স্বর কানে এসছিল, নিশাকর ধরেই নিয়েছিল তার ঠিক কী করা উচিৎ। সে নিজের এতদিনের পাওয়া দিশা, জ্ঞান এবং উপলব্ধি কাজে লাগিয়ে পরামর্শ দিতে লাগল। বুঝিয়ে বলল যে কেন তার অতীতের পথের ধারে কাছে যাওয়াটা চূড়ান্ত একটা ভুল আর নতুন কোন পথে গেলে জীবনে সত্যিকারের সাফল্য পাওয়া যাবে। ওপারে থাকা উৎসাহটা চুপ করে শুনল সব কিছু, তারপর বিদায় জানিয়ে ফোন রেখে দিল। অন্যদিকে নিশাকর বেজায় খুশি এভাবে একটা বাচ্চার জীবন গড়ে দিতে পেরে! সে দুহাত তুলে একাবার ডেকে নিল সর্বশক্তিমান ঈশ্বরকে, তারপর ধ্যানে বসে পড়ল। আবারও জোয়ার এসে তাকে প্রতিফলন দেখাতে লাগল, তারপর ভাসিয়ে নিয়ে গেল মুক্তির পথে……
বেশ কয়েকমাস হল, এখনও ঠিক বর্ণময় না হলেও চলছে নিশাকর নাথের জীবন। তবে আগের মত ধীরে সুস্থে না, তার এই জীবন চলছে রীতিমত হুড়মুড়িয়ে। এমন অবস্থা যে তাল মেলাতে মেলাতে হাঁপিয়ে উঠেছে! অথচ এরকমটা তো হওয়ার কথা ছিল না? সে তো আগের জীবনের অপ্রয়োজনীয় অংশগুলো ছেঁটে ফেলে, অনেকটা সময় নিজেকে দিয়ে, সমাজকে দিয়ে এখন এই জায়গায় এসছে! তবে ভুলটা কোথায় হল? ক্লান্ত নিশাকর আবার উত্তরের খোঁজে যায় সেখানে, যেখানে আগেরবার তার উপলব্ধির দিশা পেয়েছিল, বাড়ি থেকে চারশো কুড়ি মিটার দূরে থাকা নদীটার কাছে। আবার ঘাটে বসে মগ্ন হওয়ার চেষ্টা করল গভীর চিন্তায়, আগেরবারের মতই। চিতার আগুন, নদীর স্রোত, ঠাণ্ডা হাওয়া প্রত্যেকেই নিজের কাজে ব্যস্ত চিরকালের মতই, শুধু ওই একজনই যেন নিজের কাজ খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই!
তাহলে কি নিশাকর আবার ভুল পথে পাড়ি দিয়েছে? যেন দোলা দিয়ে উঠলো ওর চেতনা, সত্যিই তো? নইলে সমাজের জন্য এতকিছু করার পর, এতজনকে জ্ঞানের সঠিক দিক দেখানোর পরও কেন এখনও ওর নিজের জীবন এত গুমোট? এত ফিকে? বাড়ি ফিরল নিশাকর, সেদিন রাতে ঘুম হয়নি আর।
দিন কেটে যায়, নদীও থামেনা, স্রোতের অনুগামী হয়ে অস্তিত্ব হারায় গাছের ঝরাপাতা আর মহাবিশ্বের ছোট্ট পাথরকণায় অস্তিত্ব খোঁজে কোটি কোটি অণুজীব। ঠিক যেমন প্রত্যেকবার নতুন করে নদীর ধারে ঘাটে বসে নিজেকে খুঁজে পেত নিশাকর। যতবার ঘাটে গেছে, কিছু না কিছু নতুন উপলব্ধি করেছে, নতুন উদ্দেশ্য খুঁজে পেয়েছে জীবনের।
দিন কেটে যায়, লাখখানেক প্রজাপতির পরমায়ু পেরিয়ে যায়। এরমাঝেই নিশাকর একদিন ঘাটে যায়, শেষবারের মত……।