কলমধরা হাঁস

পাঁচমাথার নেতাজি | বাংলা ছোট গল্প | নেতাজি জয়ন্তীর শ্রদ্ধার্ঘ্য || Paanch Mathaar Netaji | Bengali Short Story || Netaji Jayanti Tribute

উদ্ভ্রান্ত হয়ে ছুটে চলেছে অপরাজিতা। মাথার পিছনে নিকষ কালো মেঘের হুঙ্কার আর হাতঘড়িতে ভিজিটিং আওয়ার্সর চোখরাঙানিতে তটস্থ ও এখন। 

বিকেলের ঘরফিরতি কলকাতা সময়ের আগেই আঁধার খুঁজে নিয়েছে। শহরের অবশিষ্ট গাছগুলোর চালচলনে আসন্ন আন্দোলনের পূর্বাভাস। মাঝে মাঝে অট্টালিকাদের মাথার উপর দেখা যাচ্ছে আলোকরেখার তীব্র ঝলকানি। তাদের আওয়াজ শুনলে ঠাহর হয়, বজ্রপাত খুব দূরে হয়নি। খবরে কান পাতলে শোনা যাচ্ছে, “আর কিছুক্ষণের মধ্যে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড় ও বৃষ্টির সম্ভাবনা।” 

আবহাওয়া দফতরেরও বলিহারি! এতো তাড়াতাড়ি খবর দিয়েছে!  

বজ্রপাতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান জানা থাকলেও তার পরোয়া করার সময় নেই অপরাজিতার। ওর আপাতত লক্ষ্য, ভিজিটিং আওয়ার্স শেষ হওয়ার আগে নার্সিংহোমে পৌঁছানো ও মায়ের সাথে দেখা করা।

আগেরদিন এই সময়ের ছুতোয় রিসেপশনিস্টের কাছে হেনস্থা হতে হয়েছে ওকে।  নির্ধারিত সময়ের অবশিষ্ট পাঁচ মিনিটে আসা নাকি নার্সিংহোমের প্রোটোকল ও ডিসিপ্লিন ভঙ্গ করে। অথচ ওদের এঁদোজিনোংরা কেবিনে ডিসিপ্লিন বজায় আছে, প্রোটোকল ভাঙে না যখন আয়া বা ঝাড়ুদাররা হাত বাড়িয়ে “দানাপানি” চায়। 

দুর্ভাগ্যবশত অপরাজিতা এই দ্বিচারিতার উৎস জানে।

জটিল রোগে মা শয্যা নেওয়ায় যে সে অভিভাবকহীন ও নিরুপায় তা ওই চত্বরে সবাই ধরে ফেলেছে। অতঃপর, বৈষম্য একটি সাধারণ ঘটনা এবং অবিচারেই বিচার খুঁজে নিতে হবে।

কিন্তু এসব স্বাভাবিক কি? এরকমটাই হওয়ার কথা ছিল?


নার্সিংহোম থেকে বেরিয়ে আবার দ্রুত গতিতে হাঁটতে থাকে অপরাজিতা। নার্সিংহোমের পালা শেষ হলেও শিয়রে শমন হয়ে মেঘের অন্ধকার এখনও চোখ রাঙাচ্ছে, আর তার সঙ্গ নিয়েছে ছিপছিপিয়ে বৃষ্টি। আরেকটু জোরে হাঁটলে, বারিধারা তীব্রতা বাড়ানোর আগেই হয়তো মেট্রো স্টেশন পৌঁছে যাওয়া যাবে। 

অপরাজিতা জানতো না…

এ চেষ্টা মুদ্রাস্ফীতির বাজারে খেটেখুটে রোজগার বাড়িয়ে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকার মতই–

ব্যর্থ চেষ্টা।

আকাশভাঙা বৃষ্টি যখন “রাস্তা ভাসাও, কলকাতা ডোবাও” প্রকল্প শুরু করল, অপরাজিতা তখন ফাইভ পয়েন্টের থেকে দৃষ্টিগোচর দূরত্বে একটা ছাউনির নিচে দাঁড়িয়ে। মেট্রোর দিকে যেতে গেলে বড় রাস্তা পেরোতে হবে। 

জীবনের এই ভোগান্তির সময়গুলোয় মানুষের কষ্ট অনেকক্ষেত্রে রাগ, দুঃখ বা অভিমান হয়ে বেরোতে চায় কোনো বস্তু বা ব্যক্তির ওপর। অপরাজিতারও হিসাব মত এই মুহূর্তে নিজের বাবার ওপর রাগ হওয়ার কথা। “অযোগ্য”, “ভীতু”, “মেরুদণ্ডহীন” ইত্যাদি বিশেষণ এসে মাথায় জড়ো হয়ে যায় এতক্ষণে। কিন্তু না…

আজ ওর মনে অভিমান জমছে, তাও অন্য কারোর ওপর।

বৃষ্টিভেজা শহরের এক কোণে দাঁড়িয়ে অপরাজিতা জনস্রোত মাপছে। এই জনস্রোতেই একদিন হারিয়ে গিয়েছিল এক রক্তমাংসের প্রাণ, মূল্য হারিয়েছিল মায়ের নাড়ি ছেঁড়ার যন্ত্রণা, অস্তিত্ব হারিয়েছিল বাবার তেজ। এই শহরেই হারিয়ে গিয়েছিল সে…

অপরাজিতার দাদা অনিকেত।

নিরন্তর গতির মাঝেই আরেকজন নির্বিকার; নিশ্চুপ বৃষ্টিস্নাত দাঁড়িয়ে আছে, পাঁচমাথার মধ্যমণি ঘোড়সওয়ার নেতাজি। আলোর খেলায় আর জলকণার কুয়াশাবৃত হয়ে সে মূর্তি নিজের কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য ছেড়ে ছায়ার রূপ নিয়েছে। তাঁর বীরত্বকে সেলাম জানাতে আকাশে প্যারেড করে যায় বিদ্যুৎরেখা।

বাস্তবতা বিড়ম্বনা দিলে মানুষ স্বভাব দোষে অবাস্তব আঁকড়ে ধরে।   

অপরাজিতাও নিজের বাকি থাকা প্রাণের অনুভুতি আর অস্তিত্বের জিম্মা দেয় এই আপাত প্রাণহীন মূর্তিকে। ওর মনে হল বুঝি আর কিছু নেই এই জনঅরন্যে, এই দেশে, এই দুনিয়ায়…!

ঘোর! শরীর ও মনের ক্লান্তিকে দোসর করে জড়ো হয় ঘোর! সঙ্গত দেয় বৃষ্টির আওয়াজ আর জলীয় ঠাণ্ডা। আলগা হয়ে আসে স্নায়ুর বাঁধন, ছাড়া পায় অবাধ্য কৌতূহল…

প্রশ্ন করে অপরাজিতার অধিকার, “নেতাজি…! তুমি জানো আমার দাদা কোথায়……?” 

দাদা বলতে অপরাজিতা কোনো মানুষ কে চেনে বা বোঝে না। চেনে কিছু খণ্ড স্মৃতিকে আর বোঝে মায়ের হাহাকার, বাবার উদাসীনতা। আসলে বোধশক্তি তৈরি হওয়ার মত বয়স আসার আগেই অনেক কিছু ঘটে গিয়েছিল ওর জীবনের নির্ণায়ক হিসাবে। 

এই যেমন কলকাতার এক মেস বাড়ি থেকে অনিকেতের একদিন হঠাৎ নিরুদ্দেশ হওয়া। তার কারণ, ঘটনাবলী, তথ্য-তদন্ত, মামলা, রায় কিছুই ঠিক করে জানে না অপরাজিতা।

ওর বাবা হয়তো সবটা জানে আর ওর মা জানলেও মানতে পারেনি। 

অথচ এই সমস্ত জিনিসের প্রভাব অপরাজিতার চেয়ে বেশি আর কারোর জীবনে পড়েনি। দাদা হারানোর পর থেকে সেই যে মা অসুস্থ হয়েছে; সেই মায়ের দেখভাল করা, বাবার নেওয়া পরপর ভুল সিদ্ধান্তগুলোর খেসারত দেওয়া, বাড়ির ভালো-মন্দ দেখা….

সবকিছু অপরাজিতা করে গেছে, একা!

কিন্তু এরকম হওয়ার কথা ছিল না।

আজ দাদা উপস্থিত থাকলে কষ্ট নির্মূল না হলেও, তা ভাগ করার মতো একটা মানুষ থাকতো। দিশেহারা অপরাজিতাকে ধ্রুবতারার মতো সাহায্য করতে পারতো, বাস্তবতার প্রখর রোদে ছায়ার মতো আগলে রাখতে পারতো….

ভাবতে ভাবতে গলা ধরে আসে, চোখ থেকে যাতে জল না বেরিয়ে আসে তাই আরেকটু চোখ বুঁজলো অপরাজিতা…স্মৃতির প্রবাহ ওকে নিয়ে যায় এক অজানা গলির দিকে…

অজানা গলি, অচেনা নয়!


ছোট্ট অপরাজিতা বিছানায় বসে, আপনমনে খেলনা সহযোগে নিজের জগতে মগ্ন। একটু দূরে পাশেই বসে অনিকেত, নিজেই সাদাকালো দাবার গুটি সাজিয়ে একের পর এক চাল দিয়ে যাচ্ছে। 

বাইরে বৃষ্টি সেরকম না হলেও বজ্রপাতের বহর মারাত্মক, অন্তত ৩-৪টে নারকেল গাছ আজ মৃত্যুবরণ করবে বলে ধরেই নেওয়া যায়। যদিও ঘরের আশ্রয়-স্বাচ্ছন্দ্যে থাকা দুই প্রাণের সেই চিন্তা নেই। তারা নিজেদের মস্তিষ্কে নিজেদের মতো উদ্দেশ্য নিয়ে দিব্যি আছে।

হঠাৎ তীব্র আলোর ঝলকানিতে ঝলসে গেল ওদের দৃষ্টি। সেই ধাক্কা কাটতে না কাটতেই ধেয়ে এলো তীব্র গর্জন! কেঁপে উঠলো ওদের ঘরটা, ঝনঝলিয়ে উঠলো আসবাবপত্রের কাঁচগুলো। 

মুহূর্তখানেক পর একটু সবকিছু ধাতস্থ হতেই দেখা যায়, দাদার কোলে উঠে বুকে মুখ গুঁজে ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কাঁদছে ছোট্ট অপরাজিতা। সে নিজে তো তার খেলনা উল্টে এসেছেই আবার তাড়াহুড়োতে আসতে গিয়ে দাবার বাক্সও ঘেঁটে দিয়ে এসেছে। 

অনিকেত রাগ করে না, হতাশও হয় না। সে সস্নেহে নিজের সহোদর অনুজকে কাছে টানে, মৃদু হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে বলে…

“ভয় নেই… ভয় নেই!”

ভিরমি খেয়ে চোখ খোলে অপরাজিতা। কে বললো কথাটা? চারিদিকে তাকায়, দেখে আশেপাশে লোক থাকলেও অভয়বাণী দেওয়ার মতো নয় কেউই। তাহলে? 

একটু সময় নিয়ে ভাবার পর ঠিক করলো যে এ ক্লান্তি ও খালি পেটের দোষ, তাই আর দেরি না করে ওর বাড়ি ফেরা উচিৎ।

মেট্রো স্টেশন সাবওয়ের মুখে একবার দাঁড়িয়ে যায় অপরাজিতা, কী যেন একটা চিন্তা নিয়ে ফিরে তাকায় নেতাজির মূর্তির দিকে। তারপর হাতঘড়িতে সময় দেখে এগিয়ে চলে যায় নিজের গন্তব্যের দিকে।

থেমে থাকে শুধু পাঁচমাথার নেতাজি।

সে ভূত? ভবিষ্যৎ? নাকি বর্তমান? সে উত্তর অপরাজিতারা জানে না…

কিন্তু নেতাজি জানে অপরাজিতা’দের, সে রোজ শহরের প্রাণকেন্দ্রের মধ্যমণি হয়ে সাক্ষী থাকে অগণিত অপরাজিতার আখ্যানের…! সে নিজে স্থির-স্থবির হয়ে অভিভাবকত্ব নিয়েছে চিরগতিশীল জনগণমন’র।

বিশ্বজোড়া অপরাজিতা’দের নেতাজি-ই অনিকেত!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!
Scroll to Top